২৪শে ডিসেম্বর ২০১৪, ভোরবেলা। ঢাকা টু কলকাতা ট্রেনে ভ্রমনের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। হোক পাশের দেশ, হোক ছোট্টবেলা থেকে দেখে আসা নিজের স্বদেশের মতোই ভিন্ন দেশ – প্রথম বিদেশ ভ্রমন বলে কথা। পাসপোর্ট আর লাগেজ গুছিয়ে রওনা দিলাম- গন্তব্য ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশন, মৈত্রী এক্সপ্রেসে করে যেতে হবে কলকাতা।
এর আগের কাহিনী কেবল বিড়ম্বনার। ২ দেশের সরকার সবার সুবিধার্থে অনলাইনে ভিসার এপ্লাই-এর ব্যবস্থা করেছে কিন্তু দালালের দৌড়াত্ব তাতে কমেনি বরং বেড়েছে বহুগুনে। অনলাইনে এপ্লাই করে দেখা করার ডেট মিলে না। অন্যদিকে দেড় থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ৫ হাজার টাকা দিলে দালাল এনে দিচ্ছে ভারত এম্বাসিতে দেখা করার ডেট। অবশেষে দালাল ধরে, বেশ ভাল টাকা খরচ করেই ডেট পেলাম। ৭ ডিসেম্বর সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে কাগজ জমা দেবার আগ মুহূর্তে আবার নতুন সমস্যা। আমার আর ওয়াইফ দুইজনের নতুন মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট যা বিয়ের পর করা।
ওদের ওয়েবসাইটে কোথাও লেখা নাই আগের Invalid হাতে লেখা পাসপোর্টও জমা দিতে হবে। দালাল ধরে বহু আরাধ্য ডেট পেয়ে ডেস্কে গিয়ে জানতে পারলাম নতুন-এর সাথে পুরাতন পাসপোর্ট ২ খানাও নাকি জমা দিতে হবে! তখন সকাল ৯টা। ১২ টার মধ্যে জমা না দিলে আবার নতুন করে ডেট ধরতে হবে। সিএনজি নিয়ে ছুটলাম। বাসার নীচে CNG বসায় রেখে সেই সিএনজিতে করেই ব্যাক করে সকাল ১১টার দিকে জমা দিলাম। আল্লাহর রহমতে ২ দিন পর ভিসাসহ পাসপোর্ট হাতে পেলাম। পাসপোর্টের সাথে বানানের অমিল/বাসার বিদ্যুত বিলের সাথে ভিসার এপ্লিকেশনের কারেন্ট এ্যাড্রেস না মিলার মতো কারনেও অনেকের ভিসা রিফিউজড হতে দেখলাম।
যাই হোক ট্রেনে ছাড়ার সময় ছিল ৮টা ১৫ মিনিট। ঠিক ৮টার দিকে UK থেকে ওয়াইফের বড় ভাইর ফোন। ভাইয়ার ছেলে হয়েছে। দেশ ছাড়ার আগে ভাল একটা খবর পেয়ে খুব ভাল লাগল। আমাদের সহযাত্রী ছিলেন ভারতীয় বাঙালী। উনারা বেশ অনেকজন মিলে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে তাবলীগের জন্য এসেছিলেন। যাত্রা পথে ভাল সহযাত্রী পাওয়া লাকের ব্যাপার। উনাদের সাথে কথা বলে খুব ভালই লাগল।
ঢাকা কলকাতায় মৈত্রী এক্সপ্রেসের ব্যানারে বাংলাদেশ এবং ভারত এই দুই দেশের ২টি ট্রেন আগে সপ্তাহে ৪ দিন চলাচল করত। সম্প্রতি সপ্তাহে ৬ দিন চলাচল শুরু করেছে। আমরা যাবার সময় ভারতীয় ট্রেনটা পেয়েছিলাম আর আসার সময় বাংলাদেশী। বাংলাদেশী ট্রেনটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বেশী হলেও ভারতীয় ট্রেনটা অপেক্ষাকৃত ভাল ছিল।
যাই হোক, দুপুর ২টায় পৌছালাম বাংলাদেশী ইমিগ্রেশন দর্শনাতে। এই জায়গার নাম দর্শনা না রেখে দুর্দশা রাখা উচিত। প্রায় ৩৬০ জন ট্রেন যাত্রীর জন্য মাত্র ৩-৪ জন লোক। সবাই লাইন ধরে দাড়ালাম। উনারা হাতে হাতে পাসপোর্টের ডিটেলস টাইপ করতে লাগলেন কম্পিউটারে। এই ২০১৪ সালে এসে এমন ম্যানুয়াল কর্মকাণ্ড যে কারো মাথায় আগুন ধরিয়ে দিতে যথেষ্ট। ২টা থেকে প্রায় সোয়া ৪টা পর্যন্ত লাইনে দাড়িয়ে অবশেষে পাসপোর্টে সীল পেলাম।
ট্রেনে উঠার একটু পর ট্রেন ছেড়ে দিল। ১৫০ টাকা করে মুরগীর বিরিয়ানী পাওয়া যায় তাই খেলাম। ভারতীয় ট্রেনের খাবার মান বেটার ছিল বাংলাদেশীটার তুলনায়। দর্শনা থেকে ট্রেন ছেড়ে দেবার সাথে সাথেই কিছু যাত্রীকে দেখলাম ট্রেনের দরজার কাছে গাটকী বোচকা নিয়ে দাড়াতে। একটু পর বুঝলাম বাংলাদেশী ইমিগ্রেশন দর্শনা পার হবার ২০ মিনিটের মধ্যেই আবার ভারতীয় ইমিগ্রেশন। জায়গাটার নাম গেদে স্টেশন। আগের বার লাগেজ নামাতে হয় নাই কিন্তু এইবার নাকি লাগেজ নামাতে হবে। দার্জিলিং যাব বলে সাথে ২টি লাগেজ ভর্তি কাপড় ছিল।
এগুলো সব সাথে নিয়ে নেমে পড়তে হলো গেদে স্টেশনে। ট্রেনের যাত্রীরা সবাই ছুটছে কে কার আগে লাইনে দাড়াতে পারে। আমাদের সহযাত্রীর টিমের একজনের কল্যানে প্রথম লাইনেই জায়গা পেয়ে গেলাম। ভেতরে ঢুকতেই কাস্টমস অফিসার সুন্দর করে হেসে বললেন “দাদা কিছু খরচা পাতি তো দিতে হয়”। আগে থেকেই জেনে যাওয়ায় চাহিবামাত্র দায়িত্ববানের মতো ১০০ টাকার একখানা বাংলাদেশী নোট ধরায় দিলাম। উনিও খুশি মনে যেতে দিলেন।
অবশেষে ভারতীয় সময় প্রায় রাত সোয়া ৯টায় কলকাতার চিতপুর স্টেশনে পৌছলাম। সেখান থেকে ট্যাক্সি যোগে হোটেলে উঠলাম। আমার ওয়াইফের খালাতো ভাই বাবু ভাই, আমার বন্ধু মারুফ আর অনলাইন সার্চের মাধ্যমে প্রচুর ইনফরমেশন আগেই পেয়েছিলাম। মারুফের পরামর্শমতো মাকুয়েজ স্ট্রীট এর গুলশান ইন হোটেলে ঢু মারলাম। তাদের নো ভ্যাকেন্সি ছিল তাই সেখানে উঠতে পারলাম না কিন্তু পরের দিন তারা রুম দিতে পারার আশ্বাস দিল।
গুলশান ইন একটা দারুন বাজেট হোটেল। সেটির মালিকের আরেকটি হোটেল আছে মার্ক হোটেল যেটি আবার ৩ স্টার মানের। রাত বেশী হওয়ার আর কোন হোটেল ট্রাই না করে তাতেই উঠলাম। রুম ভাড়া চাইল সাড়ে ৪ হাজার রুপী ! অবশেষে অনেক দর কষাকষির পর ২৫০০ রুপিতে রাজী হলো। ক্রিসমাসের আগের রাত- কি আর করার। রুম ভাড়া অনেক বেশী হলেও রুমটা ছিল দুর্দান্ত। পরেরদিন সকাল বেলা অবশেষে গুলশান ইনে ট্রান্সফার হলাম।
কলকাতায় সবচেয়ে বেশী বাংলাদেশী উঠে মির্জা গালীব স্ট্রীট আর মার্কুয়েজ স্ট্রীট এ। এই দুই রাস্তায় হাটলে মনে হয় বাংলাদেশেই আছি। এক লেখায় পেয়েছিলাম সেই রাস্তায় কয়েকদিন হাটলে পরিচিত কারো সাথে দেখা হয়েই যায়! অবাক করা বিষয় হলো প্রথম রাতে অনার্স লাইফের সল্প পরিচিত একজনের সাথে দেখা হয়ে গেল!
সকাল বেলা গুলশান ইনে ট্রান্সফার হয়ে বের হলাম কাঙ্খিত কলকাতা শহর ঘুরে দেখতে…(চলবে)
লিখেছেন: আদনান